‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’

সরকার কর্তৃক উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর খালেদা জিয়ার ছবির পাশে নিজের ছবি সম্বলিত সরকার বিরোধী ফেসবুক থেকে শেয়ার করা এবং ফেসবুকে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে আরেকটি ওয়ান ইলেভেন ঘটানোর হুমকি দেওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের সভায়।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের উদ্যোগে আওয়ামী লীগ কুমিল্লা উত্তর এবং চাঁদপুর জেলা কমিটি এবং উপজেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তিনদিন ব্যাপী মতবিনিময় সভার শেষ দিনে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান শিশিরের কিছু মন্তব্য সভায় উপস্থিত নেতৃবৃন্দকে হতবাক এবং ক্ষুব্দ করেছে বলে জানা গেছে। 

সভায় উপস্থিত এক নেতা বলেন, ‘এই উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা নির্বাচন নিয়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ করার মতো ঔদ্বত্যপূর্ণ আচরণ দেখিয়েছেন এবং তার কিছু মন্তব্যে তার বিরুদ্ধেই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে এসেছে।’

সভা সূত্র জানায়, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনে চাঁদপুরের সব উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। এর অংশ হিসেবে কচুয়া উপজেলা চেয়ারম্যান বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেয়ে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা দায়েরের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে নানা বিতর্কিত মন্তব্য করেন বলে জানা গেছে। এতে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ অনেকটা বিব্রত হয়েছেন। 

ঐ উপজেলা চেয়ারম্যানের বক্তব্যের পর একজন নেতা চেয়ারম্যানের নানা মন্তব্যের জবাব দেন। তিনি সভায় জানান, ঐ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কী কারণে ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছিল, তিনি সেটি বলেননি। তাকে সরকার কেন সাময়িক বরখাস্ত করেছিল, সেটও তিনি বলেননি। তিনি সভায় আরও জানান, ঐ উপজেলা চেয়ারম্যানকে সরকার সাময়িক বরখাস্ত করেছিল প্রকাশ্য দিবালোকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ কয়েকজন কর্মকর্তার সামনে একজন সরকারি প্রকৌশলীকে পেটানোর কারণে। এই ঘটনা জাতীয় গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর ঐ চেয়ারম্যান খালেদা জিয়ার ছবির পাশে নিজের ছবি সম্বলিত সরকার বিরোধী এক ডিজিটাল পোস্টার নিজের ফেসবুক থেকে শেয়ার করেন। বিএনপি-জামায়াতের কোনো সমর্থক এটি প্রথমে নিজের ফেসবুক থেকে পোস্ট করেছিল। সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের অংশ হিসেবে এই ডিজিটাল পোস্টারটি শাহজাহান শিশির তার নিজের ফেসবুক আইডি থেকে শেয়ার করেছিলেন বলে ঐ নেতা জানান। এই জন্য তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। 

আওয়ামী লীগের ঐ নেতা সভায় জানান, ঐ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। কারণ, তিনি ফেসবুকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে আরেকটি ওয়ান ইলেভেন ঘটানোর হুমকি দিয়েছিলেন। 

তিনি জানান, জাকির হোসেন মারুফ নামে আওয়ামী লীগের উপকমিটির একজন সদস্য দলের বিভিন্ন উপকমিটিতে সদস্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতাদের কিছু পরামর্শ দেন। তার এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে শাহজাহান শিশির আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে আরেকটি ওয়ান ইলেভেন ঘটানোর হুমকি দিয়েছিলেন। 

এই নেতা আরও জানান, শাহজাহান শিশির বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা বিষোদ্গার করে আসছে। এক ফেসবুক পোস্টে শাহজাহান শিশির উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞা নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। একই পোস্টে তিনি প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা সম্পর্কে চরম আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। আরেকটি পোস্টে শাহজাহান শিশির বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়েও নানা বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এইসব কারণে চাঁদপুরে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল। এই মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জশিটও দিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। কচুয়ায় প্রকৌশলী পেটানোর মামলায়ও তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘দলের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা এই ধরনের দুষ্টচক্রকে আমরা নির্মূল করবো। খন্দকার মোশতাক ৭৫ এর আগে আওয়ামী লীগই করেছিল। শফিউল আলম প্রধান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিল। এর আগে অন্য কোনো দল করেনি। দলের বিরুদ্ধে যারাই ষড়যন্ত্র করবে, তাদের আমরা চিহ্নিত করবো । ষড়যন্ত্রকারী যেই হোক তাদের আমরা নির্মূল করবো।’

এই নেতা বলেন, ‘গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীরকে যখন ঔদ্বত্যপূর্ণ মন্তব্যের কারণে দল থেকে বহিস্কার করা হয়, তখন ঐ সময়ে কচুয়ার উপজেলা চেয়ারম্যানের এই ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনাটি উত্থাপন করলে তাকেও দল থেকে বহিস্কার করা হতো। কারণ তিনি দলের একটা উপকমিটির সদস্য।’ ঐ নেতা সভায় জানান, তিনি এই বিষয়টি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় উত্থাপন করবেন। 

আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘এই ব্যক্তি দুইবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। অনেক রাজনৈতিক নেতার জীবনে এই ধরণের ভাগ্য হয় না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক, সামান্য স্বার্থের আঘাত লাগায় তিনি দল এবং সরকারের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়েছেন।’

উল্লেখ্য, কচুয়ার এই উপজেলা চেয়ারম্যানের এইসব কর্মকান্ড নিয়ে ২০২১ সালে ২ অক্টোবর দৈনিক ইত্তেফাকে ‘আরেকটি ওয়ান ইলেভেন ঘটানোর হুমকি দেওয়া’ সেই চেয়ারম্যান এখন কারাগারে’ শিরোনামে এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। 

সভা সূত্রে জানা যায়, কচুয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের ঔদ্বত্যপূর্ণ আচরণের জন্য কেন্দ্রীয় নেতারা তার উপর ক্ষুব্দ হন এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ভৎসনা করেন।

সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ এমপি। সভা পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আবু সায়ীদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি । 

উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্ মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা۔ দিপু মনি এমপি, আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক ওয়াসিকা আয়েশা খান এমপি, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড۔ সেলিম মাহমুদ,  ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সবুর, হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তির সংসদ সদস্য মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, কচুয়ার সংসদ সদস্য ড۔ মহিউদ্দিন খান আলমগীর, ফরিদগঞ্জের সংসদ সদস্য সাংবাদিক শফিকুর রহমান, মতলবের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন রুহুল, আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য ড۔ শামসুল হক ভূঁইয়া, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির আহমেদ ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটোয়ারী দুলাল, আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য বৃন্দ এবং চাঁদপুর জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ।