পদ্মা সেতু নির্মাণ এক যুগান্তকারী বিজয় : সেলিম মাহমুদ

‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের মতো বিশ্বমোড়লের খবরদারি ও হুমকি এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের প্রলোভন উপেক্ষা করে যেভাবে পদ্মা সেতুর মতো এত বৃহৎ একটি ভৌত কাঠামো নিজস্ব উদ্যোগ ও অর্থায়নে নির্মাণ করতে পারলেন, এটি শুধু দক্ষিণ এশিয়া কিংবা এশিয়া মহাদেশে নয়, সমগ্র বিশ্বে একটি মাইলফলক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত শুধু বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থই রক্ষা করেনি, তাঁর এই অসীম সাহসী সিদ্ধান্ত বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায়ও এক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। ‘ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ পদ্মা সেতু নির্মাণে শেখ হাসিনার বিস্ময়কর সাফল্য নিয়ে এক জাতীয় সেমিনারের মূল প্রবন্ধে এ কথা বলেন।  

ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, ‘বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়ে নিজের উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের কী অর্জন হয়েছে আর এর বৈশ্বিক বা আন্তর্জাতিক প্রভাব কী―এ বিষয়ে আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই।

আমাদের জাতীয় স্বার্থে এই প্রকল্প নিজেদের উদ্যোগে সফলভাবে সম্পন্ন করার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা ন্যূনতম ৫০ বছর এগিয়ে গেলাম। ‘

তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় সবচেয়ে প্রভাবশালী আন্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের নানা অন্যায্য এবং অযাচিত হুমকি ও প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে এ ধরনের একটি বিশাল কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করার কারণে বিশ্বব্যবস্থায়ও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। এ ঘটনার ফলে বিশ্বব্যাংকসহ বহুপক্ষীয় ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপরীতে উন্নয়নশীল বিশ্বের দর-কষাকষির ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে এই বিশ্বমোড়লদের নানামুখী শোষণ আর খবরদারির ওপর বড় ধরনের এক আঘাত। এর ফলে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে বহুপক্ষীয় ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জাতীয় স্বার্থবিরোধী প্রভাব কমতে শুরু করবে।  

ড. সেলিম বলেন, আর্থিক ও অর্থনৈতিক, কারিগরি ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক নিজস্ব উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে পাঁচটি ফলাফল দৃশ্যমান হচ্ছে ।  

১. নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ ভৌতকাঠামো সফলভাবে নির্মাণের ফলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের আর্থিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে।  

২. বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, দেশের উন্নয়নকে অভ্যন্তরীণভাবে সকল অঞ্চলে সুষম বণ্টনসহ দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই সেতুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।

৩. সেতু নির্মাণ, এর মালিকানা ও পরিচালনায় বিদেশিনির্ভরতা না থাকায় জাতীয় স্বার্থ সমন্বিত হয়েছে।

৪. বাংলাদেশের এই উদ্যোগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের দর-কষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ন হয়েছে।

৫. শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।

ড. সেলিম বলেন, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল উন্নয়নশীল দেশ, এমনকি উন্নত বিশ্বের কিছু দেশও বৃহৎ ভৌত কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে বহুপক্ষীয় ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্র কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার ওপর নির্ভরশীল ছিল। ইতিপূর্বে নির্মিত বাংলাদেশের সকল বৃহৎ ভৌত কাঠামোই বিভিন্ন বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তায় এবং কখনো কখনো তাদের অংশীদারত্বে সম্পন্ন হয়েছে। শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই প্রথম বাংলাদেশ কোনো উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তা ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে এবং অর্থায়নে একটি বিশ্বমানের ভৌত কাঠামো নির্মাণ করল।

আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক বলেন, শেখ হাসিনার উদ্যোগে নির্মিত পদ্মা সেতুর ওপর কেবল বাংলাদেশেরই মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এই সেতুর ওপর কোনো বিদেশি কর্তৃপক্ষের কোনো মালিকানা বা কর্তৃত্ব থাকছে না। চীন শুধু ঠিকাদারি কাজ করেছে; দেশের দুই প্রান্তের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই সেতুর ওপর কোনো বিদেশি কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না।

ড. সেলিম বলেন, বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল বার্তা দিয়েছিল। ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় তারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, বাংলাদেশে দুই কোটি মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে ওই ভয়াবহ বন্যায় একটি মানুষও না খেয়ে মরেনি। ২০০৯-১০ সালে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা যখন দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ও জোরালোভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছিলেন, তখন বিশ্বব্যাংক বলেছিল ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করতে গিয়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি ধসে পড়বে। তাদের সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ভুল প্রমাণ করেছেন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসহ সকল খাতে শেখ হাসিনার সাহসী ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিস্ময়করভাবে উন্নতি লাভ করেছে।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে চরম অমানবিক ও অপমানজনক আচরণ করেছিল। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এই অপমান মেনে নেওয়া যায় না। তারা দুর্নীতির কথা বলে এই প্রকল্পে প্রতিশ্রুত অর্থায়ন বন্ধ রাখল। পদ্মা ব্রিজের পাশাপাশি দুটি বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র (বিবিয়ানা-১ এবং বিবিয়ানা-২ প্রকল্প) নির্মাণ প্রকল্পেও বিশ্বব্যাংক ইতিপূর্বে তাদের প্রতিশ্রুত ঋণ প্রত্যাহার করল। এই প্রকল্প দুটিতে তাদের অনেক আগ্রহ ছিল। কোনো কারণ প্রদর্শন ছাড়াই তারা বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি থেকে ঋণ প্রত্যাহার করে নিল।  

ড. সেলিম বলেন, ‘কাল্পনিক দুর্নীতির কথা বলে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করলো স্বার্থান্বেষী মহল। পরে কানাডার আদালতে প্রমাণিত হলো পদ্মা ব্রিজ প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। বিশ্বব্যাংকের ঋণের তোয়াক্কা না করে শেখ হাসিনা আমাদের নিজেদের অর্থেই আজ পদ্মা ব্রিজ নির্মাণ করেছেন। ‘

তিনি বলেন, ‘এই বিশ্বব্যাংক একই সময়ে তাদের নিজেদের পলিসির ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেও বাধা দিয়েছিল। ২০১৩ সালের অক্টোবরে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সাথে এই নিয়ে আমাদের বেশ তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। ‘

তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে কিছু স্বার্থান্নেষী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বহুপক্ষীয় ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্রকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে নানা কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছে। এই সকল পদক্ষেপ ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে লবিস্টদের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই কাজগুলো করা হয়েছিল। আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস লবিস্টদের মাধ্যমে বিদেশে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে। ‘

ড. সেলিম বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই মানি লন্ডারিং হয়। তবে দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে সেই টাকা দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহারের ঘটনা খুব কমই দেখা যায়। দেশের টাকা নানাভাবে বিদেশে পাচার করে ষড়যন্ত্রকারীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে। পদ্মা সেতুসহ দেশের নানা উন্নয়নকে নস্যাৎ করার জন্য পাচার করা টাকা লবিস্টদের মাধমে তারা ব্যবহার করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার জন্য তারা বিদেশে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এই টাকা দেশ থেকে পাচার করা টাকা। চক্রটি দেশ থেকে পাচার করা টাকা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার করে যাচ্ছে।  

তিনি বলেন, বিদেশে নানা লবিস্ট ফার্মের মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে অশুভ গোষ্ঠী বাংলাদেশের ক্ষতি করতে চেয়েছে। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার আত্মবিশ্বাস, মনোবল আর সুদক্ষ নেতৃত্বের কাছে এসব কিছুই টেকেনি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ষড়যন্ত্র আর প্রতিবন্ধকতা নস্যাৎ করে এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মতো বিশ্বমোড়লদের খবরদারিকে অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা তাঁর আকাশচুম্বী মনোবল, ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা, অসীম সাহস এবং অতুলনীয় মেধা ও দক্ষতা দিয়ে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ভৌত কাঠামো পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বাঙালির স্বপ্ন জয় করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ আরো বহুদূর এগিয়ে যাবে।

আজ (শনিবার) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটি কর্তৃক আয়োজিত এই জাতীয় সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার ড. শিরীন  শারমিন চৌধুরী এমপি। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান।

আলোচনা করেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. সামসুল আলম, অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ, সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান, পানিসম্পদ ও জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত। আলোচনা সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক শবনম আজিম।