‘হেফাজত’ নামটাও ছিনতাই করা

হাল সময়ের আলোচিত নাম ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধের মতো কর্মসূচিতে ব্যাপক সহিংসতা দিয়ে শুরু, সর্বশেষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ঘিরে দেশজুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে সংগঠনটি এখন নতুনভাবে বিতর্কিত। এক দশক আগে আত্মপ্রকাশ করা এই সংগঠনটির নাম নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের নাম রীতিমতো ‘ছিনতাই’ করে হেফাজতে ইসলাম শুরু করে রাজনীতি। মূল সংগঠনের পক্ষ থেকে বারবার প্রতিবাদ জানানো হলেও তা কানে তোলেননি সংশ্লিষ্ট নেতারা।

দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম’ যেটি ১৯৪৪ সাল থেকে দেশে-বিদেশে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামেই পরিচিত। যুক্তরাজ্যেও রয়েছে সংগঠনটির শাখা। মহান মুক্তিযুদ্ধেও এই সংগঠনটির ছিল প্রশংসনীয় ভূমিকা। সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে একটি মাসিক পত্রিকাও ৪৮ বছর ধরে প্রকাশিত হয়ে আসছে। অনেকেই মনে করেন, প্রতিষ্ঠিত এই অরাজনৈতিক সংগঠনটির সুনাম পুঁজি করে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে আত্মপ্রকাশ করে ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনটি।

জানা যায়, ২০১০ সালে সরকারের নারী নীতিমালার বিরোধিতা করে একটি গোষ্ঠী মাঠে নামে। সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তারা অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে বেছে নেয় ‘হেফাজতে ইসলাম’ নাম। যে নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থানকারী ‘আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম’ নামের সংগঠনটির নাম ব্যবহার করে মাঠে নামে এই গোষ্ঠী। মূল সংগঠনটি সে সময় তাদের নাম ব্যবহার না করার জন্য একাধিকবার চিঠি এবং সশরীরে যোগাযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। ‘হেফাজতে ইসলাম’ নাম ব্যবহার না করার আশ্বাস দিলেও সে কথা রাখেননি চট্টগ্রামের উদ্যোক্তারা—এমন অভিযোগ হেফাজতে ইসলাম নামের মূল সংগঠনটির নেতাদের।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মূল সংগঠন ‘আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের’ প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত আলেম হজরত মাওলানা শায়খ লুত্ফুর রহমান বর্ণভী (র.)। তিনি পছন্দ করতেন না রাজনৈতিক দলাদলি। ১৯৭১ সালে বৃহত্তর সিলেটের কওমি মাদরাসার শীর্ষস্থানীয় আলেমদের মধ্যে তিনিই একমাত্র আলেম যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনেও তাঁর ছিল সক্রিয় ভূমিকা।

আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের গঠনতন্ত্র ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৫৪ সালে সিলেটে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সংগঠনটির জন্ম। যদিও এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৪৪ সালে। তখন স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন শায়খ বর্ণভী। কমিটির নাম ছিল ‘হেফাজতে ইসলাম কমিটি’। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৫-৪৬ সালে মৌলভীবাজারের বালিকান্দি গ্রামে কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে শায়খ বর্ণভীকে আমির নিযুক্ত করে আঞ্চলিকভাবে ‘হেফাজতে ইসলাম’ সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪ সালে সিলেটের বন্দরবাজার জামে মসজিদে এ অঞ্চলের বিশিষ্ট উলামা-মাশায়েখদের এক সভায় ‘আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম পাকিস্তান’ নামে সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। সংগঠনটির আমিরের দায়িত্ব পান শায়খ লুত্ফুর রহমান বর্ণভী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংগঠনের নাম থেকে পাকিস্তান বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশ’ যুক্ত করা হয়। সংগঠনটির নামের সঙ্গে আঞ্জুমান যুক্ত করা হলেও শুরু থেকেই এটি ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে দেশে-বিদেশে পরিচিত।

বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাহ্ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, সিলেটসহ উত্তরবঙ্গের আট জেলার দায়িত্বে ছিলেন হজরত মাওলানা শায়খ লুত্ফুর রহমান বর্ণভী, ঢাকা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন হজরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী এবং চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন ফখরে বাঙ্গাল হজরত মাওলানা তাজুল ইসলাম। ষাটের দশকে ঢাকার সিদ্দিকবাজার জামে মসজিদে আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের একটি জাতীয় সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়।

আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম কেন্দ্রীয় কমিটির নাজিমে আলা (সাধারণ সম্পাদক) অধ্যাপক মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুস সবুর বলেন, ‘আমাদের সংগঠন ৭৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে। সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচি সরকারিভাবে নিবন্ধিত। এখন আমাদের সংগঠনের নামে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা।’ তিনি আরো বলেন, মূল সংগঠনের সঙ্গে চট্টগ্রামের ‘হেফাজতে ইসলামের’ সাংগঠনিক আদর্শগত কোনো মিলও নেই। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে দীর্ঘদিনের পুরনো এই সংগঠনের নেতাকর্মীকে এখন নানা দুর্ভোগ ও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ১৯৯৯ সালে যুক্তরাজ্যে গঠিত হয় ‘হেফাজতে ইসলাম ইউকে’। যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ১১১৫৭০৯। এ ছাড়া ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে চালু করা হয় ‘হেফাজতে ইসলাম অ্যাম্বুল্যান্স সার্ভিস’, ২০০৮ সালে চালু করা হয় হেফাজতে ইসলাম মেডিক্যাল সেন্টার’ ও ‘হেফাজতে ইসলাম সমাজসেবা সংস্থা’। ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যে স্থাপিত হয়, ‘হেফাজতে ইসলাম সেন্টার লন্ডন’। অ্যাম্বুল্যান্স সার্ভিসের কার্যালয় মৌলভীবাজার শহরের শ্রীমঙ্গলে স্থাপন করা হয়। লাশ ও রোগী বহনকারী চারটি অ্যাম্বুল্যান্স ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস দিত। তবে আর্থিক কারণে ২০১১ সালের দিকে অ্যাম্বুল্যান্স সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সংগঠনটির মুখপত্র হিসেবে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা ১৯৭৩ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন মাওলানা শেখ আব্দুর রব ইছামতী। প্রথমে পত্রিকাটি হাতে লিখে প্রকাশ করা হতো। পাঠকপ্রিয়তা বাড়ায় পরে মুদ্রণযন্ত্রে পত্রিকাটি ছাপা হয়। এ জন্য মৌলভীবাজার জেলায় ‘মাদানী প্রেস’ নামে একটি ছাপাখানাও স্থাপন করা হয়। প্রথমে পত্রিকাটি মাসিক হিসেবে প্রকাশিত হলেও ১৯৮৩ সালে এটি সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। ২০০৪ সাল থেকে আবার মাসিক হিসেবে পত্রিকাটি এখনো প্রকাশিত হচ্ছে।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে নানামুখী কার্যক্রম চালিয়ে আসা ‘আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম’ সংগঠনটির নাম এবং ভাবমূর্তি ‘ছিনতাই’ হয়ে যায় ২০১০ সালে। ওই বছরের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের কিছু আলেম নারী নীতিমালার বিরোধিতা করে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম সদ্যঃপ্রয়াত মাওলানা শাহ আহমদ শফীকে কমিটির আহ্বায়ক করে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে বিভিন্ন বিষয়ে আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া হয়। বিষয়টি দীর্ঘদিনের পুরনো সংগঠন ‘আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামে’র জন্য বিব্রতকর হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় মূল সংগঠনের পক্ষ থেকে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আল্লামা শফীর কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে তাদের সংগঠনের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য এবং দেশে-বিদেশে কর্মকাণ্ড তুলে ধরে এ নাম ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তাতেও কর্ণপাত না করায় ‘আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামে’র পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ২০১০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে যায়। তারা আল্লামা শফীসহ অন্য আলেমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের সংগঠনের নাম ব্যবহার না করার জন্য ফের অনুরোধ করে। সে সময় আল্লামা শফী তাদের বক্তব্য শুনে ভবিষ্যতে এ নাম ব্যবহার করা হবে না বলে তাদের আশ্বস্ত করেন। ওই সভায় হাটহাজারী মাদরাসার তত্কালীন মুহাদ্দিন জুনাইদ বাবুনগরীও উপস্থিত ছিলেন।

পরে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আবারও হেফাজতে ইসলামের নামে সম্মেলনের ডাক দেন চট্টগ্রামের আলেমরা। এ অবস্থায় ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি মূল সংগঠনের পক্ষ থেকে আবারও আল্লামা শফীর কাছে একটি চিঠি দিয়ে এর প্রতিবাদ জানানো হয়। আশ্বাস দেওয়ার পরও ফের হেফাজতে ইসলামের নামে কর্মসূচি পালনের বিষয়টি দুঃখজনক উল্লেখ করে চিঠিতে তিনি বলেন, ‘তাঁদের এই তৎপরতায় দীর্ঘদিনের পুরনো সংগঠনটির কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’ এরপর দীর্ঘদিন হেফাজতে ইসলামের নামে কোনো কর্মসূচি পালিত না হলেও ২০১৩ সালে আবার ‘হেফাজতে ইসলাম’ নাম ব্যবহার করে মাঠে নামেন চট্টগ্রামের আলেমরা। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে ঘটে স্মরণকালের নারকীয় ঘটনা। এরপর ২০১৫ সালের শেষ দিক থেকে আবারও আলোচনায় আসতে শুরু করে সংগঠনটি। পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন, সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপন করা থেমিসের ভাস্কর্য সরানোর দাবিতে মাঠে নামে সংগঠনটি। এসব ঘটনায় মূল সংগঠন ‘আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামে’র নেতারা চরম ক্ষুব্ধ হন।

আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের এক নেতা বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী একটি অরাজনৈতিক দ্বীনি সংগঠনের নাম ও ভাবমূর্তি এভাবে ব্যবহার করা অত্যন্ত দুঃখজনক।’ তিনি বলেন, মূল সংগঠনের সঙ্গে চট্টগ্রামের ‘হেফাজতে ইসলামের’ সাংগঠনিক বা আদর্শগত কোনো মিলও নেই। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে দীর্ঘদিনের পুরনো এই সংগঠনের নেতাকর্মীকে এখন নানা দুর্ভোগ ও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

এ ব্যাপারে আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম কেন্দ্রীয় কমিটির নায়েবে আমির হজরত মাওলানা আব্দুল বারী ধর্মপুরী বলেন, ‘বর্তমান হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এই সংগঠন সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আমাদের সংগঠনের নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। এটি এখন একটি উগ্রবাদী সংগঠনে পরিণত হয়েছে।’

এ ব্যাপারে হেফাজতে ইসলামের সদ্যোবিলুপ্ত কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস বলেন, “আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের নেতারা প্রতিবাদ করেছেন এটা ঠিক, তখন আমরা বলেছিলাম তাঁদের সংগঠনের নামের আগে ‘আঞ্জুমানে’ আছে। কিন্তু আমাদের সংগঠনের নাম হেফাজতে ইসলামে বাংলাদেশ। এটি নিয়ে এখন আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।” আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামে বাংলাদেশ একটি ধর্মীয় সংগঠন, তাই এটির নিবন্ধনের প্রয়োজন নেই।